সততা ও আদর্শের ধারক গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ কুষ্টিয়ার কাঙাল হরিনাথ
সততা ও আদর্শের ধারক গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ এবং বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের জনক কুষ্টিয়ার কাঙাল হরিনাথ (১৮৩৩-১৮৯৬)। আজকের চলমান সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় তার আদর্শ যেন রূপকথারই মতো। আসলে তার সততা ও দক্ষতায় একজন প্রকৃত নির্ভীক সাংবাদিকের আদর্শ হওয়া উচিত। এই খ্যাতিমান সাধক পুরুষ কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বসবাস করে সবসময় উদার, নির্ভীক ও যুক্তিপূর্ণ মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। গণমানুষের কাছে তিনি ছিলেন সততা আদর্শের এক মহান উদার হৃদয় প্রকৃতির সাধক পুরুষ।
কাঙাল হরিনাথ এদেশে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্ত্তা’ প্রকাশ করেন এবং অগ্রসরমান সামাজিক ক্ষতগুলোকে তুলে ধরে সমাজ সংস্কারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আমরা কাঙাল হরিনাথ বলতে যাকে চিনি তার নাম ছিলো হরিনাথ মজুমদার। যদিও তিনি ওই নামে খ্যাতিমান নন, কাঙাল হরিনাথ নামে পরিচিত।
কাঙাল হরিনাথ কুষ্টিয়ার কুমারখালী শহরে ১২৪০ সালের ৫ শ্রাবণ (ইংরেজি ১৮৩৩) কুষ্টিয়া জেলার (তদানীন্তন পাবনা জেলার নদীয়া) কুমারখালী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হলধর মজুমদার এবং মা কমলিনী দেবী। তিনি ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তার জন্মের পর শৈশবেই মাতৃ ও পিতৃবিয়োগ ঘটে। এরপর দারিদ্র্যের বাতাবরণে বেড়ে উঠতে থাকেন কাঙাল হরিনাথ। তার জীবন দর্শন থেকে তাই জানা যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কালজয়ী সাধক, সংবাদিক, সাহিত্যিক, সমাজসেবক ও নারী জাগরণের অন্যতম দিকপাল কাঙাল হরিনাথ। তৎকালীন সময়ে তিনি ইংরেজ নীলকর, জমিদার, পুলিশ ও শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে হাতে লেখা পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকারে মাধ্যমে লড়াই করেছেন। অত্যাচার ও জলুমের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন কলমযোদ্ধা। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লিখে নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে ১৮৫৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর প্রাচীন জনপদের নিভৃত গ্রাম থেকে তিনি হাতে লিখে প্রথম প্রকাশ করেন মাসিক ‘গ্রামবার্ত্তা’ প্রকাশিকা।
হাজারো বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি এ পত্রিকাটি প্রায় এক যুগ প্রকাশ করেছিলেন। মাসিক থেকে পত্রিকাটি পাক্ষিক এবং পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে সাপ্তাহিক আকারে কলকাতার ‘গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত’ প্রেস থেকে নিয়মিত প্রকাশ করেন। এতে চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। ১৮৭৩ সালে হরিনাথ মজুমদার সুহৃদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এর বাবা মথুরানাথ মৈত্রেয় আর্থিক সহায়তায় কুমারখালীতে এমএন প্রেস স্থাপন করে ‘গ্রামবার্ত্তার প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন। হরিনাথের ৬৩ বছরের জীবনকালে তিনি সাংবাদিকতা, আধ্যাত্ম সাধনাসহ নানা সামাজিক আন্দোলন এবং কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেই সময়ে গ্রামীণ সাংবাদিকতা এবং দরিদ্র কৃষক ও সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। অতঃপর তিনি ছিলেন সংগ্রামী এক ভিন্ন নেশা ও পেশার মানুষ।
কাঙাল হরিনাথ নিজেই গ্রামগঞ্জ ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করতেন এবং পাঠকদের হাতে তুলে দিতেন একটি বলিষ্ঠ পত্রিকা। সাহসী এ কলম সৈনিক ১৮৭২ সালে দুঃখী মানুষের পক্ষে কালাকানুনের বিরুদ্ধে পত্রিকার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান। গ্রামে বসবাস করেও উনিশ শতকের বুদ্ধিজীবী কাঙাল হরিনাথ ১৮৬৩ সালে নীলকর সাহেব অর্থাৎ শিলাইদহের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর জমিদারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কৃষকদের পক্ষে প্রবন্ধ লিখে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। এ কারণে ঠাকুর জমিদার হরিনাথকে খুন করার জন্য ভাড়াটে গুণ্ডা পাঠান। কিন্তু বাউল সাধক লালন ফকির নিজেই তার দলবল নিয়ে কাঙালকে রক্ষা করার জন্য জমিদারের লাঠিয়ালদের প্রতিরোধ করেন। লালন ফকিরের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকার কারণেই তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন।
অত্যাচার-জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি হরিনাথ সে সময় ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’কে ঘিরে লেখক গোষ্ঠী তৈরি করেন। ফলে এ পত্রিকার মাধ্যমে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সুসাহিত্যিক রায় বাহাদুর জলধর সেন, দীনেন্দ্র কুমার রায়, মীর মশাররফ হোসেন, শিবচন্দ্র বিদ্যানর্ব প্রমুখ সাহিত্যিক সৃষ্টি করে গেছেন। এছাড়া দেড়শ বছর আগে সাহিত্য আড্ডা বসিয়ে তিনি যে জ্ঞানের দ্বীপ জ্বেলেছিলেন তা ছিল অনন্য এক দৃষ্টান্ত।
সে সময় ওই আড্ডায় নিয়মিত সময় দিতেন মীর মশাররফ হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও বাউল সম্রাট লালন ফকির। কলকাতার বৃহত্তর গুণী বাংলা সাহিত্যের কবি ঈশ্বর গুপ্ত কাঙাল হরিনাথের ভূমিকা সম্পর্কে নানা প্রশংসা গেয়ে গেছেন। বাংলা সাহিত্যে ও সাংবাদিকতা জগতের সবাই এই খ্যাতিমান সাধক পুরুষের সততা ও আদর্শ আজো শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করে থাকেন।
Leave a Reply