লালন দর্শন

প্রত্যেক মানুষকে গুরুর কাছে দীক্ষা নিতে হবে

অথর
নূর মোহাম্মদ রবিউল  কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ
প্রকাশিত :১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২:৪৬ অপরাহ্ণ
প্রত্যেক মানুষকে গুরুর কাছে দীক্ষা নিতে হবে

‘প্রত্যেক মানুষকে গুরুর কাছে দীক্ষা নিতে হবে। আর গুরুর আশ্রয়ের সাহায্যে বায়েত গ্রহণ বা দিক্ষা নেওয়ার মাধ্যমেই কেবল মানুষ আত্মতত্ব বা আধ্যাত্মিক শিক্ষা পেতে পারেন।এর কারনে একজন ভক্ত নিজের মনকে সকল অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেন। ভক্তের মন নিয়ন্ত্রিত হলে সে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে আত্মশুদ্ধি লাভ করেন,আর যারা কোন গুরুর কাছে দিক্ষা নেননি তারা আজও প্রকৃত মানুষের পর্যায়ে পরেনি, তাদেরকে দীক্ষা(গুরুপাঠ) নিতে হবে। এটাই আমাদের লালন সাঁইজীর দর্শন।’ লালন সাঁইজীর আদর্শ ধারণ করা প্রায় ১০০ বছর বয়সী নাম না প্রকাশ করতে ইচ্ছুক এক ভক্ত প্রতিবেদকে এ কথা জানালেন।

নাম প্রকাশ না করা এই লালন ভক্ত স্বাক্ষাতকারে প্রতিবেদকে আরো জানান, এক সময় গুরুর সঙ্গের নিয়মানুযায়ী সন্ধ্যার মধ্যদিয়ে সাধু সঙ্গ শুরুর সাথে রাখাল সেবা,অধিবাসকালীন সেবা,বাল্য সেবা ও পূর্ণসেবা সহ নয় আলেক ধ্বনির মাধ্যমে সাধু-সঙ্গ শেষ হতো। এছাড়াও,গদি মান্য,আসনমান্য, আচলামান্য,সেবা দক্ষিণা দিতে হতো। সাধু সঙ্গ সমাপ্ত হবার পর অশ্রুসিক্ত নয়নে সাধুরা বিদায় নিতেন। এছাড়াও তিনি বলেন, প্রত্যেক মানুষেরই আত্মশুদ্ধি তথা আত্মার মুক্তি করতে হলে কেবলমাত্র নিজ গুরুর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও যোগাযোগই হলো এই আনন্দ-উৎসব। যারা গুরু মতবাদে বিশ্বাসী না কেবলমাত্র ফেতনা-ফ্যাসাদ ও নিজেদের নাম প্রচার করে বড় সাজতে আসেন, গুরুর আশ্রমে তাদেরকে না আসায় ভাল। সবচেয়ে উদারতার বিষয় এই কথাগুলি বললেন যিনি অতঃপর তিনি নিজেকে লালন ভক্তের পরিচয় দিলেও লেখক তাঁর একটি ছবি নিতে চাইলে তিনি অনিহা প্রকাশ করেন।

মরমী সাধক লালন সাঁইজী মানুষের মাঝে গুরু বা মুর্শিদ ধরার বিষয়ে শিক্ষা দেওয়াসহ তাঁর আত্মতত্ব ও আধ্যাত্মিক সংগীত সাধনার সৃষ্টি কর্মের মাধ্যমে গুরুবাদী পথের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। আজও তাঁর ভক্ত ও গুরুবাদী মতাদর্শনগণ এই লালন দর্শনের পথ সবার মাঝে প্রচার করে আসছেন। আগেকার দিনে কুষ্টিয়া শহর সংলগ্ন কালিনদীর তীরে ছেঁউড়িয়ার লালন সাঁইজীর বাড়ীতে শুধুমাত্র লালন ভক্তরা গুরুকে নিশানা করেই সাধনা ও অনুষ্ঠান পালন করতো, যা সাধু-সঙ্গ নামে পরিচিত ছিল।

আজ গুরুর আশ্রমে অথবা লালন স্মরণোৎসবে ভক্তরা এখন আর সেই রকমটা নিজেদের ইচ্ছামত পালন করতে পারে না। এখন জনবলের বিশাল আকার ধারন হওয়ায় তাঁর দর্শনে মুরীদ না হওয়া জনসাধারণগণ বিনোদনের আখড়া হিসেবে পরিণত অতঃপর আমলা,স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে সামাজিক প্রতিষ্ঠানে রুপ দিয়েছে লালন একাডেমি। মরমী সাধক লালন শাহ তাঁর গানে বলেন, যে মুরশিদ সেই তো রাসূল ইহাতে নাই কোন ভুল খোদাও সে হয়, এ কথা লালন কয়না কোরআনে কয়। আগে কপাট মার কামের ঘরে, মানুষ ঝলক দিবে রুপ নিহারে। মানুষ ছেড়ে ক্ষেপা রে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। এসকল গানসহ লালন সাঁইজী আরো লিখেছেন সামাজিক ভেদনীতি, শ্রেণী-বৈষম্য, জাতপাতের কলহ ও সাম্প্রদায়িক বিরোধের বিরুদ্ধে লেখা।

উল্লেখ্য, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে,মানুষ গুরুর দিক্ষা দিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে মরমী সাধক লালন শাহের আবির্ভাব ঘটে ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজো অজানায় রয়ে গেছে তাঁর জন্ম রহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত। যৌবনকালে পূর্ণ লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমনে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপামত্মর ও সাধন জীবনে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহের আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি সাধক গুরুর আসনে অধিষ্টিত হন। প্রথমে তিনি কুমারখালির ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের একটি আমগাছের নীচে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন। লালন ভক্ত মলম শাহ আখড়া তৈরীর জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতে ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে।
প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরী করা হয়। সেই ঘরেই তাঁর সাধন-ভজন বসতো। ছেঁউড়িয়ার আঁখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিষ্যভক্তদের নিয়ে পরিবৃত থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক দেহত্যাগ করেন এবং তাঁর সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

শেয়ার করে  সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published.


আরও পড়ুন