আধুনিক যুগে মুসলিম বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তক মীর মশাররফ হোসেন
মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মীর মশাররফ হোসেন
আধুনিক যুগে মুসলিম বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তক ও মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হলেন সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন। তিনি তার বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেছেন। কারবালার যুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত বিষাদ সিন্ধু তার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম।
মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার গৌরবও মীর মশাররফ হোসেনের প্রাপ্য। মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা “আজিজন নেহার”। পরবতী কালে ১৮৯০ খ্রীঃ “হিতকরী” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। অতঃপর তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ।
বাঙালি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক মীর মশাররফ হোসেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ)১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার লেখাপড়ার জীবন কাটে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে ফরিদপুরের পদমদীতে ও শেষে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করে। এছাড়াও তিনি কিছুকাল কলকাতায় বসবাস করেন।
সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন প্রথম বাঙ্গালী মুসলিম উপন্যাসিক ও নাট্যকার এবং জীবন চরিত রচয়িতা করেছেন। ১৮৭৫ খ্রীঃ প্রহসনখানিক বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কর্তৃক সম্পূণ গদ্যে রচিত প্রথম প্রহসন। দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার চার বছর পর মশাররফের প্রথম উপন্যাস রত্নবতী প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি একে একে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচনা হলো- গোরাই-ব্রিজ অথবা গৌরী সেতু, বসন্তকুমারী নাটক, জমিদার দর্পণ, এর উপায় কি, বিষাদ সিন্ধু, সংগীত লহরী, গো-জীবন, বেহুলা গীতাভিনয়, উদাসীন পথিকের মনের কথা, তহমিনা, টালা অভিনয়, নিয়তি কি অবনতি, গাজী মিয়ার বস্তানী, মৌলুদ শরীফ, মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা, বিবি খোদেজার বিবাহ, মদিনার গৌরব, বাজীমাৎ, আমার জীবনী, আমার জীবনীর জীবনী বিবি কুলসুম ইত্যাদি। তার জমিদার দর্পণ নাটকটি সিরাজগঞ্জে সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত। তিনি সমকালীন সমাজের অসঙ্গতি ও সমস্যার ওপর তীক্ষ্ন কটাক্ষপাত করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। উদার দৃষ্টিকোণ থেকে ‘গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’ প্রবন্ধ লিখে তিনি নিজের সমাজ কর্তৃক নিগৃহীত হন।
‘মীর’ উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাঁর পূবর্পুরুষ থেকে। তাঁর পুরো নাম সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন। ছদ্ম নাম ছিল গাজীমিয়াঁ। তাঁর পিতা ছিলেন মীর মোয়াজ্জম হোসেন অতঃপর পিতামহ হলেন মীর এবরাহিম হোসেন। মাতা ছিলেন দৌলতন নেসা অতঃপর মাতামহ হলেন মুন্সী জিনাতুল্লা। বৈবাহিক জীবনে তিনি মাত্র আঠার বছর বয়সে তার পিতৃবন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয়। মীর সাহেবের পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার পদমদীর নিকটবতী সেকাড়া গ্রামে। মীর মোয়াজ্জম হোসেন ছিলেন লাহিনীপাড়ার নিকটবতী সাঁওতা গ্রামের জমিদার তার পিতা মীর এবরাহিম হোসেন সাঁওতার তৎকালীন জমিদার আনার খাতুনের কাছ থেকে জমিদারী লাভ করেন। ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ফরিদপুর তথা রাজবাড়ী জেলার পদমদী গ্রামে নিজ বাড়িতে মীর মশাররফ হোসেন পরলোকগমন করেন।
Leave a Reply