কুষ্টিয়া শহর সংলগ্ন ছেঁউড়িয়া মাজার প্রাঙ্গণ: লালন শাঁহের তিরোধান দিবস বরণে তাঁর অনুসারী গুরু-শিষ্যদের ভিড়ে মুখরিত

অথর
নূর মোহাম্মদ রবিউল  কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ
প্রকাশিত :১৬ অক্টোবর ২০২৪, ৩:০০ অপরাহ্ণ
কুষ্টিয়া শহর সংলগ্ন ছেঁউড়িয়া মাজার প্রাঙ্গণ: লালন শাঁহের তিরোধান দিবস বরণে তাঁর অনুসারী গুরু-শিষ্যদের ভিড়ে মুখরিত

বাউল সম্রাট ফকির লালন শাঁইজীর ১লা কার্তিক তিরোধান দিবস বরণে কুষ্টিয়া শহর সংলগ্ন ছেঁউড়িয়ায় তাঁর অনুসারী গুরু-শিষ্যদের মিলন মেলার ভিড় বসেছে। বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) সূর্য উদয়ের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিক নিয়মে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদান করতে আগে থেকে লালন অনুসারী গুরু-শিষ্য, ভক্তদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে মাজার প্রাঙ্গণ।

এসময় ভক্তরা শুরুকে বিভিন্ন ধরনের সেবাদান, বস্তুদান, আগরবাতি, মোমবাতি, আতর, ফুল ও ভক্তি দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। ভক্তরা গুরুর বাণী ও গান শ্রদ্ধাার সাথে শ্রবণ করে অতঃপর অনেকে গান গেয়ে মাজারের আশপাশে আাসা সবার মাঝে গুরু বাণী প্রচারের আসর জমিয়ে তোলে। যদিও পরে প্রতিষ্ঠান রুপে দাঁড়ানো ‘লালন একাডেমি’ প্রতি বছরের এ আয়োজনে সরকারি কর্মকর্তা, সমাজের সূধী সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা সভা, কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনাসহ গ্রামীন মেলা, মাঠ ইজারা তদারকি, তোবারক বিতরণ ও নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব নেয়। এখন বিভিন্ন দুর দূরন্তর পাশাপাশি দেশের বাহির থেকেও এই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে অনেকে আসছেন। এই অনুষ্ঠান এখন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রুপ নিয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।

এদিকে লালন শাঁহের তিরোধান দিবস বরণে ভক্তদের মিলন মেলা ও সাধুসঙ্গের আলোকে এবারও লালন শাঁহের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে তাঁর আখড়াবাড়িতে তিন দিনব্যাপী লালন মেলা, প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে আলোচনা সভা ও লালন সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার (১৭,১৮ ও ১৯ অক্টোবর) তিন দিনব্যাপী এই লালন মেলা চলবে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং লালন একাডেমি এই মেলা ও অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করছে। কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি শারমিন আখতারের তত্বাবধানে অনুষ্ঠান পরিচালনাসহ মাজার প্রাঙ্গণ ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।

লালন শাঁইজীর ভক্তদের মাধ্যমে জানা গেছে, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদানের মধ্য দিয়ে গুরুর বাণী ও গান প্রচারের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। গুরু পাঠ নিয়ে গুরু সেবার মাধ্যমে নিজেকে একজন প্রকৃত মানুষ হওয়ায় এই পথের মূল লক্ষ্য। গুরুর হাতে বায়েত গ্রহণ করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি-ভালবাসার দিয়ে সন্তুষ্টি অর্জন ও নিজেকে ভাল মানুষ হিসেবে তৈরি করা। সকল ধর্মের নারী-পুরুষ সবাইকে একজন গুরুর দীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে আমাদের লালন দর্শনে।

লালন সাঁইকে তার শিষ্যদের কাছে ‘সাঁইজি’ নামে পরিচিত। ফকির লালন সাঁইকে আমরা যাকে লালন শাহ, মহাত্মা লালন, মরমি কবি ফকির লালন সাঁই, বাউল সম্রাট, মরমি সাধকসহ একাধিক নামেও চিনি। লালন জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ, গোত্রের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষ ও মানবতাকে বড় করে দেখেছেন। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সমন্বয়ে লেখা গানগুলো অধিকাংশ ইসলাম, সুফিবাদ ও দেহতত্ত্ব নিয়ে।

তিনি লিখেছেন, পারে কে যাবি নবির নৌকাতে আয়। রুপ কাঠের ই নৌকাখানি নাই ডুবার ভয়। আরো লিখেছেন, যে মুর্শিদ সেই তো রাসুল, ইহাতে নাই কোন ভুল, খোদাও সে হয়। লালন কয় না এমন কথা কোরাণে কয়। মানুষ ছেড়ে ক্ষেপা রে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার, আগে কপাট মার কামের ঘরে, মানুষ ঝলক দিবে রুপ নিহারে গানসহ লালন সাঁইজী আরো লিখেছেন সামাজিক ভেদনীতি, শ্রেণী-বৈষম্য, জাতপাতের কলহ ও সাম্প্রদায়িক বিরোধের বিরুদ্ধে লেখা।

মরমী সাধক লালন শাঁইজী মানবকূলে বিদায়ের পর থেকে কুষ্টিয়া শহর সংলগ্ন ছেঁউড়িয়া মাজার চত্বরে তাঁর ভক্ত ও আশেকানদের ১ লা কার্তিক অন্তর্ধান দিবস বরণের মিলন মেলা উদযাপিত করে আসছে। লালন অনুসারীরা দিনটি উপলক্ষে আগেই বহু দুর থেকে দলে দলে সকল ভক্ত ও আসেকানদের ভিড় জমে উঠে ছেঁউড়িয়া লালন শাঁইজীর নিজ বাসভবনে। লালন শাঁইজীর মাজারের চারিপাশে ভক্তরা নানা সাজে মেতে উঠে ভক্তি প্রদানে।

উল্লেখ্য, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে,মানুষ গুরুর দিক্ষা দিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে মরমী সাধক লালন শাহের আবির্ভাব ঘটে ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজো অজানায় রয়ে গেছে তাঁর জন্ম রহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত। যৌবনকালে পূর্ণ লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমনে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপামত্মর ও সাধন জীবনে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহের আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি সাধক গুরুর আসনে অধিষ্টিত হন। প্রথমে তিনি কুমারখালির ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের একটি আমগাছের নীচে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন। লালন ভক্ত মলম শাহ আখড়া তৈরীর জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতে ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে। প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরী করা হয়। সেই ঘরেই তাঁর সাধন-ভজন বসতো। ছেঁউড়িয়ার আঁখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিষ্যভক্তদের নিয়ে পরিবৃত থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক দেহত্যাগ করেন এবং তাঁর সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

শেয়ার করে  সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published.