মনের পশুত্ব স্বভাব ত্যাগের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ অর্জনই কোরবানির শিক্ষা
চন্দ্র সাল তথা আরবী বছরের জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ পবিত্র ঈদুল আযহা। এই খুশির দিনটি উপলক্ষে মুসলমানগণ সকল ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সারা বছরের জমে থাকা হিংসা-বিদ্বেষ গ্লানি মুছে ফেলে। আর পরিবার-সমাজের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ও পরস্পর সহানুভূতিশীল মন সৃষ্টি করেন। এই কোরবানি থেকে সকল মুসলমানগণ মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে সমস্ত লোভ, হিংসা, ক্রোধ, স্বার্থপরতা তথা ভেতরের পশুত্বকে ত্যাগের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধি লাভ অর্জন করেন ।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কিন্তু মনে রেখো! কোরবানির গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ সচেতনতা। এই লক্ষ্যেই কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দেওয়া হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমাদের সৎপথ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে কল্যাণ দিয়েছেন, সেজন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো। হে নবি! আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিন যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৭-৩৮)
পবিত্র ঈদুল আযহার এই দিনে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মুসলমানেরা সবাই আত্মনিবেদিত হয়ে বিভেদ ও বৈষম্যহীন সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার অঙ্গিকার করে থাকেন। হালাল রিজিক-কর্মের কোরবানির মধ্যে রয়েছে মহা কল্যাণকর দিক যা- আল্লাহর রাজি-খুশি অর্জন এবং আত্মীয়- স্বজন ও অভাবী মানুষের খোঁজ-খবর নেওয়া। মহান সৃষ্টিকর্তার কোরবানির গোশত বা পশুর রক্তের প্রয়োজন নেই। তিনি শুধু দেখতে চান বান্দার মনে আল্লাহ প্রতি ভয় ও ভক্তিসহ অন্তরের পশুস্বভাব বিসর্জন দিয়ে সৃষ্টির সেরা মানুষের প্রতি এবং সকল জীবের প্রতি কতটুকু ভালবাসা রয়েছে।
‘আর তুমি তাদের কাছে আদমের দুই ছেলের (হাবিল-কাবিল) সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে কোরবানি পেশ করলো। এরপর তাদের একজন থেকে (কোরবানি) গ্রহণ করা হলো আর অপরজন থেকে গ্রহণ করা হলো না। সে বললো, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করবো’। অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের থেকে (কোরবানি) গ্রহণ করেন’।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ২৭)
পবিত্র কুরআনে কুরবানীর বদলে ‘কুরবান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হাদীছেও ‘কুরবানী’ শব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে এর পরিবর্তে ‘উযহিয়াহ’ ও ‘যাহিয়া’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর এজন্যই কুরবানীর ঈদকে ‘ঈদুল আযহা’ বলা হয়। আর আযহা শব্দটি আরবীতে ‘কুরবান’ ফারসী বা ঊর্দূতে ‘কুরবানী’ রুপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। পারিভাষিক অর্থে ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়। আর কোরবানির শাব্দিক অর্থ ত্যাগ। জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখে পরম ত্যাগের নির্দেশনা স্বরূপ বিশ্ব মুসলিম মহাসমারোহে হজ্বের অন্যতম অংশ পশু জবাইয়ের মাধ্যমে কোরবানি ও ঈদুল আযহা উৎসব পালন করে। সুতরাং ত্যাগের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যে উৎসবে মিলিত হয় তাই ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ।
মহান আল্লাহর আওলিয়া পীরানে পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র.) বলেছেন- ” হজ্ব হলো আল্লাহকে দর্শন করা। কুরবানী হলো ফানা হওয়া এবং কুফরীর পর্দা ছিন্ন করে দেওয়া “। কুরবানীর পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার পূর্বে নিজেদের মধ্যে লুক্কায়িত পশুত্বের গলায় ছুরি দিতে হবে। মহান আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণকারী ও আত্মত্যাগী হতে হবে। তাকওয়া ও আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন বা মুত্তাকী হতে হবে। আমাদের সালাত, কুরবানী, জীবন-মরণ সবকিছু আল্লাহর জন্যই উৎসর্গ হোক, ঈদুল আযহায় বিধাতার নিকট এই হোক মোদের প্রার্থনা।
‘প্রত্যেক জাতির জন্য আমি কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; যাতে তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে, যেসব জন্তু তিনি রিজিক হিসেবে দিয়েছেন তার উপর। তোমাদের ইলাহ তো এক ইলাহ; অতএব তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ কর; আর অনুগতদেরকে সুসংবাদ দাও, যাদের কাছে আল্লাহর কথা উল্লেখ করা হলে তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে, যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।’ (সুরা হজ:আয়াত ৩৪-৩৫)
নবী-রাসূল,ওলি-আওলিয়াগণ ও প্রকুত মুসলমানদের কুরবানীর লক্ষ্য ছিল কেবল পশু ত্যাগের সাথে সাথে যত মহৎ গুণাবলীর স্বভাবের মধ্য দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভ অর্জন করা । সবাই সেই লক্ষ্য পূরণে অঙ্গিকারবদ্ধ হোক। বর্তমান সময়ের হালাল জীবিকা দ্বারা নিত্য দিনের অল্প চাহিদা পরিমাণ রেখে দরিদ্র অসহায়ের মাঝে জবেহকৃত প্রাণীর সমস্ত গোসত বিলিয়ে দিয়ে কদাচিৎ ত্যাগ প্রকাশ করুক। আপনাদের সকল মহৎ কাজের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এই উৎসবের খুশীতে সবাইকে জানাই ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা ও সেই সাথে আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ।
Leave a Reply