সারাবিশ্বে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী(র.)-এঁর আজমীর শরীফের ওরস আত্মশুদ্ধির মিলন মেলা হিসেবে পরিচিত
সারাবিশ্বে সর্বস্তরের সকল মানুষের কাছে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী(র.)এঁর আজমীর শরীফে প্রতি বছরের ওরস শরীফ আত্মশুদ্ধির মিলন মেলা হিসেবে পরিচিত। প্রতিবারের মত এবারও ভারতের আজমীরে তাঁর ওরসে লাখ-কোটি মানুষের আত্মশুদ্ধিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে যাওয়া মানুষের বিশাল ঢলেতে এক শান্তির মহামিলন মেলা সৃষ্টি হয়েছে। এবারেও তার ভক্ত ও আসেকানদের এই পবিত্র ওরস তথা ইবাদতের মহা মিলন মেলা আরবী মাসের পহেলা রজব থেকে শুরু হয়েছে। যা ৬ ই রজব পর্যন্ত চলবে।
হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (র:) এঁর দরগাহ যা খাজা বাবার মাজার নামেও পরিচিত। এটি ভারতের রাজস্থানের আজমীর জেলায় অবস্থিত। ভারতবর্ষের একমাত্র সর্বধর্ম মিলনক্ষেত্র এই আজমীর। হিন্দু, মুসলিমসহ সকল সম্প্রদায়ের কাছে মহান তীর্থস্থান আজমীর। সারা বছরই লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রান মানুষের পদভারে মুখরিত থাকে মাজার কমপ্লেক্স। সর্বধর্মের এমন বৃহত্তর মিলনক্ষেত্র পৃথিবীতে ২য় আছে কিনা সন্দেহ। শ্বেত মর্মরের সমাধিবেদী, রূপার রেলিং, সোনায় মোড়ানো সিলিং, রূপার পাতে মেড়ানো এর বুলুন্দ দরজা। ১২৩৬ এ ইলতুতমিশের হাতে শুরু হয়ে ১৬ শতকে সম্রাট হুমায়ুনের হাতে এই বুলুন্দ দরজার কাজ শেষ হয়। মাজারের প্রবেশ ফটকটি হায়দ্রাবাদের নিজাম তৈরি করেন। সম্রাট আকবর ১৫৬৭ সালে ৩০ মিটার উচুঁ মূল প্রবেশ পথের বুলুন্দ দরজাটি তৈরি করেন। আজমীরের খাজা বাবার মাজারের আরেকটি দর্শনীয় বস্তু হলো ১২০ মন ও ৮০ মন চাউলের বিরিয়ানী রান্না করার দুটি ডেকচি। প্রতি বছর আরবী মাসের ১ থেকে ৬ রজব তার ওফাত দিবসে এখানে রান্নার আয়োজন করা হয়।
খাজা মইনুদ্দিন চিশতী(র) হলেন বিশ্ব মহামানব রাসুল সাঃ-এঁর আহলে-বাইতের হযরত আলী কঃ, জগত জননী মা ফাতিমা ও ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন( বেহেস্তের সর্দার)-এঁর বংশধরের মধ্য চিশতীয়া ধারার ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত কামেল ওলি ও কুতুবে মোশায়েখ।খাজা গরীব নেওয়াজ মঈনুদ্দীন চিশতী (রঃ) এঁর এবারের পবিত্র ওরশ মোবারক উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ভক্ত- আসেকানদের আল্লাহর মনোনীত অলির দরগাহ তথা আজমীর শরীফে উপস্থিত হয়ে ফাতেহা- দরুদ পাঠের ইবাদাতে অংশগ্রহণ করছেন।
তিনি ১১৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন ও ১২৩৬ সালে ওফাত হন। তিনি গরিবে নেওয়াজ নামেও পরিচিত। মইনুদ্দিন চিশতীই উপমহাদেশে প্রথম এই ধারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করেন। তিনি ভারতে চিশতী ধারার মাধ্যমে রাসুল সাঃ বেলায়েতী আধ্যাত্মিক ধারা বা সিলসিলা এমনভাবে পরিচিত করেন। পরবর্তীতে তাঁর অনুসারীরা যেমন, বখতিয়ার কাকী, বাবা ফরিদ, নিজাম উদ্দিন আউলিয়া(র.)সহ (প্রত্যেকে ক্রমানুযায়ী পূর্ববর্তীজনের শিষ্য) আরো অনেকে ভারতের ইতিহাসে আহলে-বাইতের ধারাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান অতঃপর বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়।
ধারনা করা হয়,খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ৫৩৬ হিজরী/১১৪১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পারস্যের সিশতান রাজ্যের চিশতীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্যে বেড়ে উঠেন। পনেরো বছর বয়সে তার পিতা-মাতা শাহাদতবরণ করেন। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে একটি উইন্ডমিল ও একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। কিংবদন্তী অনুসারে, একদিন তিনি তাঁর ফলবাগানে পানি দিচ্ছিলেন তখন তার ফলবাগানে আসেন বিখ্যাত কামেল ওলি শেখ ইবরাহিম কুন্দুজী (কুন্দুজী নামটি জন্মস্থান কুন্দুজ থেকে এসেছে)। যুবক মইনুদ্দিন তটস্থ হয়ে যান এবং কুন্দুজীকে কিছু ফল দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এর প্রতিদানস্বরূপ কুন্দুজী মইনুদ্দিনকে এক টুকরা রুটি দেন ও তা খেতে বলেন। এই পর তিনি তার সম্পত্তি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গরীবদের মাঝে বিতরণ করে দেন। এরপর তিনি বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চ শিক্ষার জন্য বুখারার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক মহামানব রাসুল সাঃ-এঁর আহলে-বাইতের হযরত আলী (ক.)-এঁর বেলায়েতী সিলসিলার ধারার এক মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বীয় রাসুল সাঃ-এঁর নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তারই মাধ্যমে প্রায় ৯৬ লক্ষ লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তার বিখ্যাত একটি গ্রন্থ হল “আনিসুল আরওয়াহ”। এছাড়াও তিনি কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকীকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পন করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব সূর্যোদয়ের সময় পর্দার আড়াল হন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী(র.) তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন। তাঁর স্বরণে প্রতিবছর ১লা রজব হতে ৬ রজব পর্যন্ত আজমির শরীফে তাঁর সমাধিস্থলে পবিত্র ওরস অনুষ্ঠিত হয়। নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে এখানে সমবেত হয়।
Leave a Reply