“লালন শাঁইজীর মাজার জিয়ারতে ১লা কার্তিক অন্তর্ধান দিবস বরণে কুষ্টিয়া ছেঁউড়িয়া গুরু বাড়ীতে তাঁর ভক্তরা মিলন মেলার আয়োজন করে”
“লালন শাঁইজীর মাজার জিয়ারতে ১লা কার্তিক অন্তর্ধান দিবস বরণে কুষ্টিয়া ছেঁউড়িয়া গুরু বাড়ীতে তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা এই মিলন মেলা মহাত্মা লালন শাঁইজী ওফাতের পর থেকে আয়োজন করে আসছেন। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদানে মধ্য দিয়ে গুরুর বাণী ও গান প্রচারের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। গুরু পাঠ নিয়ে গুরু সেবার মাধ্যমে নিজেকে একজন প্রকৃত মানুষ হওয়ায় এই পথের মূল লক্ষ্য। গুরুর হাতে বায়েত গ্রহণ করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি-ভালবাসার দিয়ে সন্তুষ্টি অর্জন ও নিজেকে ভাল মানুষ হিসেবে তৈরি করা। সকল ধর্মের নারী-পুরুষ সবাইকে একজন গুরুর দীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে আমাদের লালন দর্শনে”। – লালন শাঁই-এঁর শতবছরের অধিক বয়েসী ভারত থেকে আগত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভক্ত প্রতিবেদকের স্বাক্ষাতকারে এই কথাগুলো বলেন।
লালন সাঁইকে তার শিষ্যদের কাছে ‘সাঁইজি’ নামে পরিচিত। ফকির লালন সাঁইকে আমরা যাকে লালন শাহ, মহাত্মা লালন, মরমি কবি ফকির লালন সাঁই, বাউল সম্রাট, মরমি সাধকসহ একাধিক নামেও চিনি। লালন জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ, গোত্রের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষ ও মানবতাকে বড় করে দেখেছেন। তাঁর পথচলা প্রথম জীবন শুরু হয়েছে রাধা-কৃষ্ণ ও কালী প্রেম দিয়ে । মাঝ জীবনে গেয়েছেন দেহ তত্ত্বের গান। শেষ জীবনে ঝুকে ধরেছেন নবী রসূলের দিকে। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সমন্বয়ে লেখা গানগুলো অধিকাংশ ইসলাম, সুফিবাদ ও দেহতত্ত্ব নিয়ে।
তিনি লিখেছেন, পারে কে যাবি নবির নৌকাতে আয়। রুপ কাঠের ই নৌকাখানি নাই ডুবার ভয়। আরো লিখেছেন, যে মুর্শিদ সেই তো রাসুল, ইহাতে নাই কোন ভুল, খোদাও সে হয়। লালন কয় না এমন কথা কোরাণে কয়। মানুষ ছেড়ে ক্ষেপা রে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার, আগে কপাট মার কামের ঘরে, মানুষ ঝলক দিবে রুপ নিহারে গানসহ লালন সাঁইজী আরো লিখেছেন সামাজিক ভেদনীতি, শ্রেণী-বৈষম্য, জাতপাতের কলহ ও সাম্প্রদায়িক বিরোধের বিরুদ্ধে লেখা। তবে তিনি তার গানে ভক্তদের শরিয়াত পালন করার কথাও বলেছেন। একটি গানের মধ্যে লিখেছেন : বে-শরাব নেয়ে যারা, তুফানে যাবে মারা, একই ধাক্কায়। কি করবে তার বদর গাঁজী থাকবে কোথায়। এখানে লালন তার অনুসারিদের আরও পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন যে- যারা নবির দেওয়া শরা বা শরিয়াত পালন না করবে, তারা এক ধাক্কাতেই তুফাণে পড়ে মারা যাবে। তার মানে লালন সকলকে নবির দেওয়া শরা পালনের জন্য বলেছেন, নিজের গড়া কোন আইন মানতে বলে নাই।
মরমী সাধক লালন শাঁইজী মানবকূলে বিদায়ের পর থেকে কুষ্টিয়া শহর সংলগ্ন ছেঁউড়িয়া মাজার চত্বরে তাঁর ভক্ত ও আশেকানদের ১ লা কার্তিক অন্তর্ধান দিবস বরণের মিলন মেলা উদযাপিত করে আসছে। লালন অনুসারীরা দিনটি উপলক্ষে আগেই বহু দুর থেকে দলে দলে সকল ভক্ত ও আসেকানদের ভিড় জমে উঠে ছেঁউড়িয়া লালন শাঁইজীর নিজ বাসভবনে। লালন শাঁইজীর মাজারের চারিপাশে ভক্তরা নানা সাজে মেতে উঠে ভক্তি প্রদানে।
তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা অনেকেই আগে থেকেই গুরু বাড়িতে এসে গুরুর মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদনে, বিভিন্ন ধরনের সেবাদানে এবং আগরবাতি, মোমবাতি, আতর, ফুল দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। ভক্তরা গুরুর বাণী ও গান শ্রদ্ধাার সাথে শ্রবণ করে অতঃপর অনেকে গান গেয়ে মাজারের আশপাশে আাসা সবার মাঝে গুরু বাণী প্রচারের আসর জমিয়ে তুলে।
এরই আলোকে ১লা কার্তিক (১৭ অক্টোবর ২০২২) সোমবার লালন শাঁইজীর ভক্ত-অনুসারীরা তাঁদের মতে মিলন মেলার অনুষ্ঠান আয়োজন করছে।
এছাড়াও আজকের প্রতিষ্ঠান রুপে দাঁড়ানো ‘লালন একাডেমি’ প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ০১, ০২ ও ০৩ কার্তিক ১৪২৯ (১৭, ১৮ ও ১৯ অক্টোবর ২০২২) সোম, মঙ্গল ও বুধবার ৩ (তিন) দিনব্যাপী আলোচনা সভা ও লালন সংগীতানুষ্ঠানসহ গ্রামীন মেলা আয়োজন করেছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে স্থানীয় লালন একাডেমির আয়োজনে অতিথিদের নিয়ে চলবে আলোচনা সভা। আলোচনা শেষে লালন একাডেমির শিল্পীদের নিয়ে চলবে লালন সংগীতানুষ্ঠান। পাশাপাশি লালন একাডেমির খোলা মাঠে বসছে গ্রামীণ মেলা।
উল্লেখ্য, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে,মানুষ গুরুর দিক্ষা দিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে মরমী সাধক লালন শাহের আবির্ভাব ঘটে ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজো অজানায় রয়ে গেছে তাঁর জন্ম রহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত। যৌবনকালে পূর্ণ লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমনে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপামত্মর ও সাধন জীবনে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহের আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি সাধক গুরুর আসনে অধিষ্টিত হন। প্রথমে তিনি কুমারখালির ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের একটি আমগাছের নীচে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন। লালন ভক্ত মলম শাহ আখড়া তৈরীর জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতে ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে। প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরী করা হয়। সেই ঘরেই তাঁর সাধন-ভজন বসতো। ছেঁউড়িয়ার আঁখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিষ্যভক্তদের নিয়ে পরিবৃত থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক দেহত্যাগ করেন এবং তাঁর সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়।
Leave a Reply