অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই, অদক্ষ চালক, যান্ত্রিক ত্রুটিসহ বিভিন্ন কারণে
সাত বছরে দেশে নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে চার হাজার ২৩৮ জনের
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত সাত বছরে দেশে চার হাজার ৭৯১টি নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে চার হাজার ২৩৮ জনের। আহত হয়েছেন দুই হাজার ৭১৪ জন। বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি নৌ দুর্ঘটনা ও মৃত্যু হয় ঢাকা বিভাগে, সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে।
দেশের নৌপথে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনার চিত্র নতুন নয়। প্রতি বছর নদীপথে চলাচল করতে গিয়ে অকালে ঝরে অনেক প্রাণ। গত বছরের জুন মাসে বুড়িগঙ্গা নদীতে মর্নিং বার্ড লঞ্চের ওপর এমভি ময়ূর-২ নামের জাহাজ উঠে গেলে লঞ্চটির ৩৪ যাত্রীর প্রাণহানি হয়। সবশেষ মাস তিনেক আগে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে মধ্যরাতে যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি অভিযান-১০ এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৪ জনের মৃত্যুতে কেঁপে ওঠে পুরো দেশ। এতে আহত হন শতাধিক যাত্রী।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে অন্যান্য পরিবহনের তুলনায় নৌপথ হতে পারতো যাতায়াতের সহজ মাধ্যম। একটা সময় ছিল সেরকমই। তবে দৃশ্যপট পাল্টেছে। বদলেছে নদী ও নৌ পরিবহনের বাস্তবতা। দখল-দূষণে এরই মধ্যে বহু নদ-নদী নাব্য হারিয়ে ধুঁকছে। নৌ ব্যবস্থাপনায়ও নেই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি। এরপরও ব্যয়সাশ্রয়ী নদীপথই এখনো লাখ লাখ মানুষের যোগাযোগ ও চলাচলের প্রধান মাধ্যম।
তবে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অদক্ষ চালক, যান্ত্রিক ত্রুটি, নৌযান চালনায় প্রতিযোগিতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুমতি ব্যতিরেকে নতুন ইঞ্জিন লাগানো, নৌযান চালনায় নিয়মভঙ্গসহ নানাবিধ কারণে নৌপথ এখন মৃত্যুফাঁদ। যেখানে বছরের বিভিন্ন সময় ঘটছে বড়োসড়ো দুর্ঘটনা। যাত্রীদের নিরাপত্তায় লঞ্চে লাইফ জ্যাকেট বা লাইফ বয়া কম থাকা, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম না থাকা, বাকেটে পানি বা বালি যাত্রীরা জরুরি প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে নৌ দুর্ঘটনায় বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা।
দেশের নদীপথে স্মরণকালের বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০০৩ সালে, চাঁদপুরে। ঢাকা থেকে ভোলাগামী ‘এমভি নাসরিন-১’ নামের লঞ্চটি অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বোঝাই করায় তলা ফেটে তলিয়ে যায়। সরকারি হিসাবে, এতে ৬৪১ জনের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য দেওয়া হলেও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা প্রায় ৮০০।
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে এক লঞ্চের সঙ্গে অন্য লঞ্চের ধাক্কা, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, বৈরী আবহাওয়ায় লঞ্চ চালনা, আগুন ও বিস্ফোরণ, মানবসৃষ্ট ভুল, নৌরুট ও বন্দরের দুর্বল ব্যবস্থাপনা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তবে যাত্রীদের অসচেতনতার কারণেও কখনো কখনো নৌ দুর্ঘটনা ঘটে।
দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন নৌপথে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াত। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করে বেশি ভাড়া আদায়ের হিসাব কষতে গিয়ে লঞ্চ মালিকরা ঝুঁকি নিয়েই নৌ চলাচলে সায় দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতেই ঘটে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা। অথচ একটি দুর্ঘটনার তদন্তকাজ শেষ হতে না হতেই নতুন কোনো দুর্ঘটনা সেটিকে চাপা দেয়। নৌপথের এ অব্যবস্থাপনা নিরসনে মালিকপক্ষ থেকে শুরু করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা বিভিন্ন সময় আশ্বাসের কথা শোনালেও কার্যত অবস্থার কোনো উন্নতি বা পরিবর্তন নেই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, অতিরিক্ত যাত্রী ও ভাড়া আদায়, ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সার্ভে সনদ ও রুট পারমিট প্রদান, অদক্ষ চালকসহ নানা কারণে নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটে। বাসের মতো লঞ্চেও মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ইঞ্জিন বা বডি নিয়ে অসংখ্য যাত্রীর জীবন নিয়ে খেলছেন লঞ্চ মালিক ও চালকরা। বছর বছর লঞ্চের ভাড়া বাড়ানো হলেও যাত্রীসেবা ও যাত্রীদের নিরাপত্তা এখনো সেকেলে। এতে নৌপথে মৃত্যুঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে ২০১৬ সাল থেকে যেসব লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় ৫৪ শতাংশই অন্য নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষ ও ধাক্কা লেগে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে ২৩ শতাংশ, বাকি ২৩ শতাংশ দুর্ঘটনা অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, লঞ্চের তলা ফেটে, যান্ত্রিক ত্রুটি, আগুন ও বিস্ফোরণের কারণে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হলেও দেশে নৌ চলাচলে এখনো সময়োপযোগী ও কার্যকরী কোনো আইন নেই। বিষয়টিকে অত্যন্ত দুঃখজনক মনে করছেন নৌখাত সংশ্লিষ্টরা। ১৯৭৫ সালের পর দেশে সামরিক শাসন চলাকালে অভ্যন্তরীণ জলসীমায় নিরাপদ ও দুষণমুক্ত নৌ চলাচল নিশ্চিত করতে ‘দ্য ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এরপর প্রায় ৪৭ বছর পেরিয়েছে।
Leave a Reply