পীর সাধকের পূণ্যভূমি প্রাচীন শহর রাজশাহী

রাজশাহীকে কুপ্রথা মুক্ত করেছিলেন হযরত শাহ মখদুম (রহ.)

অথর
শরীফ সুমন  কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ
প্রকাশিত :৪ এপ্রিল ২০২২, ৩:৫৭ অপরাহ্ণ
রাজশাহীকে কুপ্রথা মুক্ত করেছিলেন হযরত শাহ মখদুম (রহ.)

বহু পীর সাধকের পূণ্যভূমি এই প্রাচীন শহর রাজশাহী। এক সময় এই জনপদের মানুষ কুসংস্কার আর অপসংস্কৃতি ও কুপ্রথার অন্ধকারের অতলে নিমজ্জিত ছিল।

ওই সময় এই মহানগরে দেব-দেবীর নামে নরবলি দেওয়া হতো। মানুষে-মানুষে ছিল ভেদাভেদ।
তখন থেকে পীর সাধকের আগমন ঘটতে থাকে।
সুদূর মধ্য প্রাচ্যসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁরা আসেন।তাঁরা অবোধ মানুষের মাঝে জ্ঞানের দ্বীপ্ত শিখা জ্বালানোর উদ্দেশে জীবনের সব সময়টুকু সময় ক্ষয় করে দেন। তাঁদের ডিঙ্গাতে হয় নানা প্রতিকূলতার দেয়াল। যুদ্ধ এমনকি প্রাণ বিসর্জনও দিতে হয় অনেককে। এদেরই একজন জ্ঞান তাপোশ পদ্মার পাড়ে চীর শায়িত আছেন হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ)। ইসলাম ধর্মের দাওয়াত নিয়ে বাগদাদ থেকে আসা সেই সুফী সাধকের নামে এখনও পরিচিত হয় রাজশাহী।
রাজশাহী মহানগরের পদ্মার তীর ঘেষে গড়ে ওঠা শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) এর মাজার বা দরগা শরীফের কারণে ওই এলাকার নামই এখন দরগাপাড়া। দরগা মসজিদে প্রতিদিন ওয়াক্তিয়া নামাজে শতাধিক লোকের সমাগম ঘটে। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে ওরোশ মোবারকসহ নানা ইসলামি আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এদিন দরগায় তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। আর পবিত্র রমজান মাস এলে যেন রোজাদারদের হাট বসে। প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক রোজাদারকে ইফতার করানো হয় সেখানে।

আর পুরোনো বিশ্বাসের জায়গা থেকে বিভিন্ন মনোবাসনা পূরণ বা শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) এর মাধ্যমে আল্লাহ্’র কাছে অপার সন্তুষ্টি লাভের আশায় এখানে এসে ধর্মপ্রাণ নর-নারীরা নফল নামাজ আদায়সহ নানা ইবাদত করে থাকেন। অনেকে আবার মাজার জিয়ারত করেই চলে যান। এছাড়া হিন্দু পরিবারের অনেক নারীদেরও প্রতি বৃহস্পতিবার মাজারে গিয়ে নিজ নিজ আস্থার জায়গা থেকে শিরনি বিতরণ করেন।

বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন হিসেবে হযরত শাহ মখদুম (রহ.) এর মাজার নির্মাণের সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রযেছে। শ্যামপুর শিলালিপি ও একটি ফারসি শিলালিপির বরাত দিয়ে অনেকেই বলে থাকেন, সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এটি নির্মিত। পরে আলী কুলী বেগ মাজারের আমূল সংষ্কার করে বর্তমান গম্বুজটি নির্মাণ করেন।

যতদূর জানা যায়, জনৈক মুসলিম সওদাগর নদী পথে বিপদগ্রস্ত হয়ে হযরত শাহ মখদুমকে (রহ.) স্মরণ করেন। তিনি সেই বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে এই মসজিদ নির্মাণ করেন।

উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে দুইটি করে চারটি তাক ও একটি করে দুইটি জানালা রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে সমপরিমাপের তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এর কপাটগুলি পরবর্তিকালে নির্মাণ করা হয়। ২০ শতাব্দীর শুরুর দিকে পরপর দুটি বারান্দা ও মিনার নির্মাণ করা হয় এখানে।

বিভিন্ন গ্রন্থে জানা যায় হযরত শাহ মখদুম (রহ.) ছিলেন, বড় পীর আবদুল কাদের জ্বিলানী (রহ.) এর পৌত্র এবং আজাল্লাহ শাহ’র দ্বিতীয় পুত্র। হযরত শাহ মখদুমের প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল কুদ্দুছ জালালুদ্দীন। তিনি ৬১৫ হিজরী ২ রজব বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত শাহ মখদুম রূপস (রহ.) চৌদ্দ শতকের একজন মুসলিম দরবেশ, যিনি বরেন্দ্র অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। ৬৮৫ হিজরিতে (১২৮৬ খ্রিস্টাব্দে) তিনি তাঁর বড় ভাই সৈয়দ আহমদ ওরফে মীরন শাহকে নিয়ে বাগদাদ হতে এখানে আসেন।

রূপোশ তার উপাধি। আর শব্দটি ফারসি। ‘মখদুম’ অর্থ ধর্মীয় নেতা। আর রূপোশ অর্থ মুখ আবারনকারী। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, চিশতিয়া তরিকার একটি উপদলের দরবেশদের মতো তিনি তাঁর মুখমণ্ডল একটুকরা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন এবং এজন্য তাঁকে রূপোশ বলা হতো। ৬৮৭ হিজরিতে (১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে) শাহ মখদুম রূপস বাঘা হতে রামপুর বোয়ালিয়ায় চলে আসেন। তিনি ওই এলাকার অত্যাচারী তান্ত্রিক রাজাকে পরাজিত ও নিহত করে জনগণকে অত্যাচার হতে রক্ষা করেন।

প্রতি বছর ১০ মহররম হযরত শাহ মখদুমের দরগায় ওরোশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন তাজিয়া বের করা হয় এবং লাঠি খেলা ও নকল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধের মহড়া হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম এ দরবেশের নামে রাখা হয়েছে। এছাড়া তার নামেই রয়েছে রাজশাহীর ‘হযরত শাহ মখদুম বিমান বন্দর’ ও ‘শাহ মখদুম থানা’।

তার রূপোশ উপাধি থেকে এই কথা বোঝা যায় যে, হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) এর রাজশাহী আগমনের অন্তরালে পাওয়া বিস্তৃত ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে মোঘল বীর হালাকু খান বাগদাদ আক্রোমণ করলে বড় পীর আবদুল কাদের জ্বিলানী (রহ) এর বংশধররা বাগদাদ থেকে কাবুল, কান্দাহার, পারস্য ও পাক ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) এর পিতা আজাল্লা শাহসহ দিল্লিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
উন্নত চরিত্র ও গুণাবলীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহতার কাছে বায়েত হন। পিতার সহচার্যে তিন পুত্র সৈয়দ মুনির উদ্দীন আহমেদ (রহ.), হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) ও সৈয়দ আহমদ তম্বরী (রহ.) আধ্যাত্মিক সাধনায় সমৃদ্ধি লাভ করেন। হালাকু খানের মৃত্যুর পর শাহ আজাল্লা বাগদাদে ফিরে যান।

তাঁর পুত্ররা ইসলামের বাণী প্রচারের জন্য বাংলায় আগমন করেন। তখন রাজশাহী মহানগরের নাম ছিল মহাকাল গড়।

এখানে মহকাল দেবের বিখ্যাত মন্দিরে নরবলি দেওয়া হতো। তার স্মৃতি এখনও হজরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) দরগা শরীফে রক্ষিত আছে। মহাকাল গড়ে সেময় বহু রকমের দেব দেবতার প্রতিমূর্তি ও মঠ-মন্দিরে পূর্ণ ছিল। হযরত শাহ মখদুম (রহ.) রূপোশের সমাধি সৌধের প্রবেশ দ্বারে উপরিভাগে জনৈক আলীকুলী বেগ কর্তৃক রচিত ১০৩৬ ইঞ্চি চার লাইন বিশিষ্ট একটি ফারসি ভাষায় লিখিত শিলা লিপি আছে।

এই লিপিতে শাহ দরবেশের মাজারের ওপর গম্বুজ নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। (১০৪৫ হিজরী বা ১৬৩৫ খ্রি) শিলা লিপির সারমর্ম অনুযায়ী আলীকুলী বেগ দ্বাদশ মতাবলম্বি গোঁড়া শিয়া মুসলমান এবং পাস্যের শাহ আব্বাসের একজন ভক্ত ছিলেন।

তিনি এ দেশের নবাগত হিসেবে স্থায়ী মুসলমানদের সহানুভূতি লাভের আশায় হজরত শাহ মখদুম (রহ.) এর সমাধি নির্মাণ করেছিলেন। আলীকুলী বেগ হযত শাহ মখদুম (রহ.) এর সঠিক পরিচয় জানতেন না। তাই তিনি লিপিতে শাহ দরবেশ’ হিসেবে হযরত শাহ মখদুম (রহ.) সম্বোধন করেছেন। অথচ ফারসি তায়েদাদে হযরত শাহ মখদুম রূপোশ নামের কথা উল্লেখ আছে। তাই আজও তিনি শাহ মখদুম ও তার মাজার শরীফ মখদুমের দরগা এবং হিন্দুদের কাছে মখদুম বাবা নামে পরিচিত।

রাজশাহীর কেন্দ্রীয় জামেয়া ইসলামিয়া শাহ্ মখদুম মাদ্রাসা অধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা শাহাদত আলী জানান, ধর্মীয় কুসংস্কারের জায়গা থেকে এখনও মাজারকে ঘিরে নানা কাজকর্ম হয়ে থাকে যা শরিয়ত সম্মত নয় এবং শিরকের মধ্যে পড়ে। এপরপও শিরক থেকে দূরে থাকার জন্য বিভিন্ন সময় মানুষকে সচেতন করা হয়। সেখানে থাকা মসজিদে জুম্মার বিশাল জামায়াতেও মসজিদের ইমাম তার বয়ানে মানুষকে সচেতন করছেন।

এরপরও এক শ্রেণির মানুষ জায়েজ নয় এমন কাজ করে থাকেন। দরগা স্টেট সেখানে থাকা মসজিদ ও মাজার পরিচালনা করেন।মসজিদে পাঁচ হাজার মুসল্লির ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। তবে বর্তমানে এর সংস্কার কাজ চলছে। কাজটি শেষ হলে পরিধি আরও বাড়বে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

শেয়ার করে  সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published.