রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন: কুষ্টিয়া
ভাষার জন্য কুষ্টিয়ার মানুষের কিছু কথা ইতিহাসের পাতায়
ভাষার জন্য আজ থেকে সত্তর বছর আগে কুষ্টিয়ার মানুষের কিছু কথা ইতিহাসের পাতায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কুষ্টিয়া জেলায় তিনদিন সম্পূর্ণ হরতাল পালন করে কুষ্টিয়াবাসী। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিল তা পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়নি এখনও!
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর থেকেই দেশদুটিতে রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বহুভাষিক ভারতে তখন কোন সর্বভারতীয় ভাষা ছিল না। এজন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রনায়কগণ এক ভাষার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবোধ গঠনের লক্ষ্যে ভারতের একটি আঞ্চলিক ভাষা হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা আর পাকিস্তান অংশে মুসলিম শাসকগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ভাষা করার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের রাষ্ট্রভাষার এ ঘোষণাকে বাংলা ভাষাভাষী ভারতীয়রাও মেনে নিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তৎকালীন তমদ্দুন মজলিস, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদসহ প্রভৃতি সংগঠন তখন জনসাধারনের মাঝে ব্যাপক প্রেরণা সঞ্চার করেছিল। যার কারণে শত নিপীড়নের পরও বাঙালিরা রাষ্ট্রভাষার দাবি থেকে সরে আসেনি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে গতিধারা সারা বাংলায় বিস্তৃত হয়েছিল তার তরঙ্গ এসেছিল কুষ্টিয়াতেও ।
১৯৫০ সালে কুষ্টিয়ার রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলনে জুলফিকার হায়দার (কুষ্টিয়া হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক) রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলন বেগবান করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে চলেন। কেন্দ্রের পরামর্শক্রমে তিনি নিজে আহবায়ক হয়ে নজমউদ্দিন আহমেদ, সামসুজ্জোহা, জালালউদ্দিন খান প্রমুখদের নিয়ে তমদ্দুন মজলিসের জেলা শাখা গঠন করেন। ১৯৫১ সালে কুষ্টিয়ায় তমদ্দুন মজলিসের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার সভাপতি এবং নজমউদ্দিন আহমেদ সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে মুহা. সিরাজ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট চৌধুরী জালালউদ্দিন আহমদ, খন্দকার তালেব আলী, ওবায়দুল্লাহ, আব্দুল হক এই সংগঠনে যোগদান করেন। তাদের নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে আলোচ্য বিষয় ছিল, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার উপযুক্ততা, পাাকিস্তানের সংখ্যগরিষ্ঠ জনগনের ভাষা হিসাবে এর প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি। তারা তমদ্দুন মজলিসের বার্ষিক সম্মেলন করেছিলেন কুষ্টিয়াতে। পরিমল থিয়েটারে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্থপতি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, সৈনিক পত্রিকা সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল গফুর, সাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলী, ফরিদ আহমেদ, দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অ্যাডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান, শ্রমিক নেতা সোলাইমান খান প্রমুখ নেত্ববৃন্দ। সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী খালিদ হোসেন।
বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে কুষ্টিয়া জেলার মানুষ গৌরবময় অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে। পাকিস্তানের ২৫ বছরের শাসনামলে যে সকল গণআন্দোলন হয়েছে তাতে এ জেলা বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছে- তেমনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও কুষ্টিয়া জেলায় তিনদিন সম্পূর্ণ হরতাল পালন করে কুষ্টিয়াবাসী। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকার রাজপথে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ, পুলিশের গুলিতে শহিদ সালাম, বরকত, শফিক, জব্বার এদের আত্মত্যাগের খবরে কুষ্টিয়াতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এই সংগ্রামী অভিযান গতিশীল রাখতে তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে এক সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির তালিকায় ছিলেন সভাপতি ব্যারিস্টার আব্দুল হক, সেক্রেটারি জুলফিকার হায়দার, সদস্য নজমউদ্দিন আহমেদ, খালেকুজ্জামান, দেওয়ান আহমেদ, ডা. আব্দুল আজিজ প্রমুখ। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সাড়া দিয়ে সেদিন কুষ্টিয়ায় স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মোহিনী মিলস্, রেণউইক-যজ্ঞেশ্বরসহ সমস্ত কল-কারখানা অচল হয়ে পড়েছিল। সারা শহর মিছিল মিটিংয়ে উত্তাল হয়েছিল। কুষ্টিয়ার এক কৃতিসন্তান অবিভক্ত বাংলার সাবেক মন্ত্রী প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য শামসুদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন এবং প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে পরিষদে ভাষণ দিয়েছিলেন। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কর্ম তৎপরতায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রভাব কুষ্টিয়াতে এতটাই বিস্তৃৃত হয়েছিল যে কুষ্টিয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এহিয়া খান চৌধুরী, মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কুষ্টিয়া সফরের সময় কালো পতাকায় সংবর্ধিত হবার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি আব্দুল হক সাহেবকে মেহেরপুরে বহির্গমনে পাঠান এবং কুষ্টিয়ার তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা অ্যাডভোকেট সা’দ আহমেদকে স্বগৃহে অন্তরীণ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে একমাত্র গ্রেপ্তার হন কেণী রোডের শওকত আলী।
কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় (বর্ষ ১৮: সংখ্যা ৩৭) ভাষা সৈনিক নজমউদ্দিন আহমেদ এর একটি স্বাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এই স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেন: ‘যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিল তা পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়নি এটা দু:খজনক। দেশে আজ অপসংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে। দেশীয় সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। এজন্য তিনি সাংস্কৃতিক চর্চা এবং প্রচারকে আরও বাড়িয়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দেন।’
আত্মপ্রীতির উজ্জীবনী শক্তিতে আমাদের যাত্রাকে অকুণ্ঠ করে তুলতে পারে। একমাত্র সেই পথেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতির পরও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্য সম্প্রসারিত হতে পারে, তার রক্তদান চিরকালের জন্যে স্বার্থকতা খুঁজে পেতে পারে। আচার আর অনুষ্ঠান নয়, নতুন সংস্কৃতি-ঐতিহ্য গড়ে তোলার জীবন্ত আন্দোলনই হবে শহিদদের স্মৃতির মিনার। নতুন সংস্কৃতি গড়ার আন্দোলন আজকের চেতনা ও একুশের চেতনা আমাদের উদ্বুদ্ধ করুক। নতুন সংস্কৃতি গড়ার আন্দোলন দীর্ঘজীবী হউক।
লেখকঃ ড. এমদাদ হাসনায়েন। লাশকাটার মোড়, কুষ্টিয়া। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Leave a Reply